জীবন এক সংঘর্ষময় যাত্রা। কিছু সংঘর্ষ আমাদের গড়ে তোলে, কিছু আমাদের থামিয়ে দেয়, আর কিছু পুরো সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। প্রকৃতির চারটি সাধারণ শব্দ—ঘর্ষণ, ধর্ষণ, আকর্ষণ ও বর্ষণ—শুধু পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষা নয়; বরং সমাজ ও মানবিক অনুভূতির গভীর প্রতিচ্ছবি।
ঘর্ষণ: বাধা নাকি শক্তির উৎস?
ঘর্ষণ ছাড়া গতি নেই, গঠন নেই। পদার্থবিজ্ঞানে যেমন এটি চলমান বস্তুকে থামায়, আবার সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে স্থিতিশীলতা আনে, সমাজেও তেমনই ঘর্ষণ এক বিরাট ভূমিকা রাখে। প্রতিটি সফল মানুষের জীবনে কিছু না কিছু প্রতিকূলতার ঘর্ষণ থাকে, যা তাকে গড়ে তোলে। কিন্তু যখন এই ঘর্ষণ অন্যায়ভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটি সমাজের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন নারী যখন শিক্ষার আলো পেতে চায়, তখন সমাজের কিছু অংশ তাকে থামিয়ে দিতে চায়। নারীর স্বাধীনতায় যারা বাধা দেয়, তাদের এই নেতিবাচক ঘর্ষণই ধর্ষণের মতো অপরাধকে উৎসাহিত করে।
ধর্ষণ: সভ্যতার কলঙ্ক
সমাজের সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধগুলোর মধ্যে ধর্ষণ এক দানবীয় চিত্র। এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়; এটি মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। প্রতিদিন খবরের পাতায় ধর্ষণের ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। এটি কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়; এটি পুরো সমাজের চরম ব্যর্থতা ও নৈতিক দুর্বলতার প্রতীক।
ধর্ষণ কখনো আকর্ষণের ফল নয়; এটি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের অপব্যবহার। একজন ধর্ষক কেবলই অপরাধী—তার অপরাধের জন্য ভুক্তভোগীকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নৈতিক অবক্ষয় এবং অসুস্থ মানসিকতাই এই অপরাধকে দিনের পর দিন বাড়িয়ে তুলছে। একটি ধর্ষণের ঘটনা শুধু একজন নারীকে নয়, পুরো মানবতাকে অপমানিত করে। একজন নিরপরাধ মেয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তার মানসিক শান্তি চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়, সমাজ তাকে বোঝা মনে করে—আর অপরাধীরা দম্ভের সঙ্গে বেঁচে থাকে!
আকর্ষণ: সৌন্দর্যের সীমারেখা
আকর্ষণ প্রকৃতির এক স্বাভাবিক নিয়ম। এটি মানুষের অনুভূতির সঙ্গে জড়িত, সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু আকর্ষণ আর লালসার মধ্যে পার্থক্য থাকা জরুরি। সুস্থ আকর্ষণ মানুষকে প্রেম ও সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে যায়, আর অসুস্থ আকর্ষণ সমাজে ধর্ষণের মতো বিকৃত মানসিকতা গড়ে তোলে।
আজকের সমাজে অনেকেই আকর্ষণকে বিকৃতভাবে দেখে, যেখানে প্রেম ও সম্মতির চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনই মুখ্য হয়ে ওঠে। প্রেম যেখানে দুটি মানুষের পারস্পরিক সম্মতি, সেখানে ধর্ষণ একতরফা বিকৃত আকাঙ্ক্ষা। তাই আমাদের শিখতে হবে আকর্ষণকে সুস্থভাবে ধারণ করা, অন্যের সম্মান ও স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেওয়া।
বর্ষণ: ন্যায়বিচারের বর্ষণ নাকি বিচারহীনতার বিষবৃষ্টি?
বর্ষণ যেমন ধরণীর জন্য আশীর্বাদ, আবার অতিবৃষ্টি হলে তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়; ঠিক তেমনই ন্যায়বিচারের বর্ষণ সমাজকে শুদ্ধ করে, আর বিচারহীনতার বর্ষণ সমাজকে পচিয়ে ফেলে। যদি সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, তবে অপরাধীরা ভয় পাবে। কিন্তু যদি অপরাধীরা রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক শক্তির বর্ষণে রক্ষা পেয়ে যায়, তাহলে অন্যায় আরও বাড়বে।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে ধর্ষণের শাস্তি আইনত কঠোর হলেও, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রভাবশালী অপরাধীদের রক্ষা পাওয়ার প্রবণতা এবং ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করার সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। ন্যায়বিচারের বর্ষণ তখনই হবে, যখন দ্রুত ও নিশ্চিত শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে।
উপসংহার: পরিবর্তন সম্ভব, যদি আমরা চাই
ঘর্ষণ আমাদের চলার পথে থাকবে, কিন্তু সেটি গঠনমূলক হতে হবে। আকর্ষণ থাকবে, কিন্তু সেটি সম্মান ও নৈতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বর্ষণ হবে, কিন্তু সেটি ন্যায়বিচারের, অন্যায়ের নয়।
কিন্তু ধর্ষণ? এটি কখনোই কোনো সমাজের অংশ হতে পারে না। এটি সভ্যতার জন্য অভিশাপ, একটি দানবীয় বিকৃতি, যা শুধু কঠোর শাস্তি, নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। সমাজকে বদলাতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা কি এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে প্রতিটি নারী রাতে ঘরে ফেরার পথে আতঙ্কে থাকবে? নাকি আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে ঘর্ষণ হবে শক্তির উৎস, আকর্ষণ হবে ভালোবাসার প্রতিচিত্র, বর্ষণ হবে ন্যায়বিচারের, আর ধর্ষণ থাকবে ইতিহাসের পাতায়—বাস্তবে নয়?
পরিবর্তন সম্ভব, যদি আমরা চাই, যদি আমরা লড়ি, যদি আমরা একসাথে দাঁড়াই।
ভাবনায়:
শুভংকর বড়ুয়া
প্রভাষক, পাতাবাড়ি, উখিয়া, কক্সবাজার